ওয়ার্ধা পরিকল্পনা বিস্তারিত আলোচনা করো।

ওয়ার্ধা পরিকল্পনা (১৯৩৭) বিস্তারিত আলোচনা করো।

উত্তর:- ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের হরিপুরা অধিবেশন এবং ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দের করাচি অধিবেশনে জনসাধারণের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাকে আবশ্যিক করার প্রস্তাব করা হয়। গান্ধিজি প্রাথমিক শিক্ষাকে আর্থিক দিক থেকে যেমন স্বয়ংসম্পূর্ণ করার কথা ভাবলেন তেমনি আবার জীবন বিচ্ছিন্ন শিক্ষার বিরোধিতাও করেছিলেন।
ভারত শাসন আইন ১৯৩৫ প্রবর্তিত হবার ফলে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে ভারতের সাতটি প্রদেশে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে জাতীয় কংগ্রেস মন্ত্রীসভা গঠন করে। তখন জাতীয় স্বার্থে শিক্ষা সংস্কারের প্রশ্নটি বিশেষ গুরুত্ব লাভ করে।



১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে 'হরিজন' পত্রিকায় একটি নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধের মাধ্যমে গান্ধিজি তাঁর শিক্ষা সম্বন্ধে ধ্যানধারণা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, শিক্ষা বলতে আমি বুঝি শিশুর দেহ, মন ও আত্মার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ। সাক্ষরতা হলো শিক্ষার একমাত্র পথ। আমি প্রয়োজনীয় এবং উপযোগী শিল্পের মাধ্যমে দ্বিতীয় পথে শিশুশিক্ষার সূচনা করতে চাই। তিনি শিক্ষা পরিকল্পনায় সুতোকাটা, বস্ত্রবয়ন, কাঠের কাজ, হস্তশিল্প প্রভৃতির মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন। এছাড়াও শিক্ষার মূলে থাকবে তহিংসাব আদর্শ এবং তা গ্রাম্যজীবনের উপযোগী হতে হবে।
ভারতের অধিকাংশ প্রদেশে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ায় এই শিক্ষাব্যবস্থা কার্যকরী করবার সুযোগ আসে। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে অক্টোবর মাসে কংগ্রেস শাসিত প্রদেশগুলির শিক্ষামন্ত্রীগণ ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদদের নিয়ে গুজরাটের ওয়ার্কয় মহাত্মা গান্ধির সভাপতিত্বে সর্বভারতীয় শিক্ষা সম্মেলন আহ্বান করা হয় এবং এতে নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলি গৃহীত হয়।
১.তৎকালীন সময়ে শিক্ষাব্যবস্থায় উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে ছিল ইংরেজি। ফলে শিক্ষিত ও অশিক্ষিতদের মধ্যে প্রচন্ড বিভেদ সৃষ্টি হতো। যে প্রচলিত প্রাথমিক শিক্ষা ছিল তাতে জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই সার্থকতা উপলব্ধি করা যেত না। এই সমস্ত কারণে বর্তমান শিক্ষা পদ্ধতি দেশের কোনো কাজেই লাগে না ।
২.প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে তার সময় সাত বছর করতে হবে। পাঠ্যক্রমে বৃত্তিশিক্ষা ও সাধারণ জ্ঞানকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে এবং ইংরেজির ওপর জোর কমিয়ে দিতে হবে।
৩.ছাত্রদের বৃত্তিগ্রহণের মাধ্যমে এমন শিক্ষা দিতে হবে যা দিয়ে তারা বিদ্যালয়ের পাওনা অর্থ দিতে সক্ষম হবে। বৃত্তির মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিত্বের মর্যাদা লাভ করবে।
৪.উচ্চশিক্ষা ব্যক্তিগত প্রচেষ্টার দ্বারা অর্জন করতে হবে এবং উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্য হবে জাতীয় মঙ্গলসাধন শিক্ষা সম্বন্ধে গান্ধিজির এই নতুন 'আদর্শ বিবেচনার জন্য সম্মেলনে একটা উপসমিতি নিয়োগ করা হয় ।
উপসমিতি নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলি করে :
১.সমগ্র জাতির জন্য সাতবছরব্যাপী বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
২.মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়া উচিত।
৩.এই শিক্ষায় শিক্ষার্থীকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত একটা হাতের কাজ শেখানো হবে।
৪. সম্মেলন আশা করে যে, ধীরে ধীরে এই শিক্ষা থেকে শিক্ষার ব্যয় উঠে আসবে। এই প্রস্তাবগুলিকে সামনে রেখে একটি পাঠক্রম রচনা করে মহাত্মা গান্ধির নিকট পেশ করার জন্য জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়ার অধ্যক্ষ ডা: জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে একটি কমিটি গঠিত হয়। কমিটি সবদিক বিচার করে রিপোর্ট দেয়। ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় কংগ্রেসের হরিপুরা অধিবেশনে ওই রিপোর্টের প্রস্তাবগুলি গৃহীত হয়। ওয়ার্ধার সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে পরিকল্পনাটি ওয়ার্ধা পরিকল্পনা নামে খ্যাত।
গান্ধিদর্শনে পরিকল্পিত এই শিক্ষা জাতীয় শিক্ষা ও সংস্কৃতির বুনিয়াদরূপে গ্রাহ্য। শিশুর জীবনের প্রয়োজন ও আগ্রহকে কেন্দ্র করে গঠিত এবং ভারতীয় সমাজজীবনের শিক্ষা বলে অ্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।
সমালোচনা : এই রিপোর্টের বেশ কিছু অংশ যথেষ্ট সমালোচিত। যেমন -
১.শিক্ষার থেকে শিক্ষকদের বেতন উপার্জন অত্যন্ত কঠিন এবং আদর্শের দিক দিয়ে অগণতান্ত্রিক।
২.এই শিক্ষা মূলত ছিল গ্রাম্য জীবনকে কেন্দ্র করে।
৩.স্ত্রীশিক্ষার ক্ষেত্রে এতে পৃথকভাবে কিছু ভাবা হয়নি ।
৪.শিল্পের জন্য বেশি সময় ব্যয় করলে অন্যান্য বিষয়ের জ্ঞান থেকে শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত হবে।
মূল্যায়ন : সমালোচিত অংশগুলি অনেকটা সত্য হলেও এই পরিকল্পনা ভারতীয় শিক্ষাক্ষেত্রে এক নতুন আদর্শের সূচনা করে। প্রচলিত একঘেঁয়ে পাঠ্যক্রম থেকে সম্পূর্ণ স্বাতন্ত্র এই শিক্ষা যে জীবন উপযোগী তাতে কোনো সন্দেহ নাই। এর মধ্যে নিহিত শ্রমের প্রতি মর্যাদা ও কর্মের সঙ্গে সাম্যের আদর্শের প্রয়োজনীয়তাও আমাদের দেশের পক্ষে গভীর অর্থবহ।

Post Comments

No comments:

Powered by Blogger.