শাস্তি কি ? শাস্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ গুলি সংক্ষেপে আলোচনা কর।
উত্তর:- শাস্তি কি : মানুষ হল সমাজবদ্ধ জীব। সমাজের প্রতি তার কিছু দাবদধতা আছে, সে নৈতিক নিয়ম শৃঙ্খলায় বিশ্বাসী। যখন কেউ নৈতিক নিয়ম ভা করে তখন তার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা থাকে। আরে রাষ্ট্র নানা পন্থায় সমাজের সদস্যদের নৈতিক জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে। তার মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা হল শাস্তিদানের পদ্ধতি।
শাস্তি সম্পর্কে প্রতিরোধাত্বক মতবাদ
প্রতিরোধাত্মক ক্ষত : শান্তি নিয়ে যে সব মতবাদ প্রচলিত রয়েছে প্রতিরোধাত্মক তত্ত্ব তার মধ্যে অন্যতম। এই মত অনুযায়ী অপরাধীকে শাস্তি দেবার উদ্দেশ্য হল এমন উদাহরণ স্থাপন করা যাতে অন্যরা ঐ জাতীয় অন্যায় থেকে শাস্তির ভয়ে বিরত থাকে। প্রতিরোধাত্মক মতবাদের ‘মূল’ সূত্র ব্যাখ্যার জন্যে প্রাসঙ্গিকভাবেই অনেকেই বিচারের একটি উক্তির উল্লেখ করেন—তুমি ছাগল চুরি করেছ বলে তোমাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না, তোমাকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ আর না ছাগল চুরি করে।
সমালোচকরা বলেন এই মতবাদে অপরাধীকে উদ্দেশ্য সাধনের উপায় হিসাবে ব্যবহার করা হয়। দার্শনিক লিলি মনে করেন, একমাত্র মৃত্যুদন্ড ছাড়া শাস্তির প্রতিরোধাত্মক উদ্দেশ্যটি অপরাধীর উপরই বিশেষ কার্যকর হয়।
শাস্তি সম্পর্কে প্রতিশোধাত্মক মতবাদ:
প্রতিশোধমূলক সুর: এই মতবাদ জোরের সঙ্গে বলে যে, অপরাধীকে অপরাধের ফল ভোগ করতেই হবে। অপরাধীকে বোঝাতে হবে, তার অপরাধের ফল শুধু অপরেরই দুর্ভোগ হয় না, নিজেকেও ভুগতে হয়। তাই এই মতবাদের মূল সুর -'চোখের বদলে চোখ', 'দাঁতের বদলে দাঁত ।
নৈতিক নিয়মের রক্ষক : এই মতবাদ যেন নৈতিক নিয়মের রক্ষকরূপে আমাদের সামনে আবির্ভূত হয়। প্রতিশোধাত্মক মতবাদ অনুসারে শাস্তি হল ন্যায়পরায়ণতার ব্যবহারিক প্রয়োগ। শাস্তির কোন উদ্দেশ্য নেই, শাস্তি নিজেই নিজের উদ্দেশ্য। মানুষের অন্তনির্হিত ন্যায়বোধ দাবী করে যে, অপরাধী অপরাধের দ্বারা নৈতিক নিয়ম ভঙ্গ করেছে, তাই শাস্তি তার প্রাপ্য। শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলে মানুষ নৈতিক নিয়ম-শৃঙ্খল মানবে কেন? নৈতিক নিয়মের মহিমা সর্বোচ্চ এবং বাধ্যতামূলক। অপরাধী নৈতিক নিয়মের গৌরবকে অপমানিত করেছে। নৈতিক নিয়মের হৃত গৌরব ফিরিয়ে আনার জন্যই শাস্তির ব্যবস্থা। এখানে অপরাধী যে নৈতিক নিয়মকে আঘাত- করে, শাস্তির দ্বারা তা পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
মৃত্যুদন্ড সমর্থন : এই মতবাদে অবস্থা-বিশেষে প্রাণদন্ড সমর্থন করা যায়। যেহেতু অপরাধী একজনকে হত্যা করেছে তাই ন্যায়পরায়ণতা দাবী করে যে, অপরাধীরও বাঁচার কোন অধিকার নেই। অনেকে এই মতবাদকে খ্রীষ্টধর্মের বিরোধী মনে করেন।
শাস্তি যেন পুরস্কার : সমাজে ভাল কাজের যেমন পুরস্কার আছে তেমনি মন্দ কাজেরও পুরস্কার আছে। মন্দ কাজের পুরস্কার নেতিবাচক। নেতিবাচক পুরস্কারকেই শাস্তি বলে। এই মতবাদের দুটি রূপ আছে কঠোর এবং কোমল ।
১.কঠোর প্রতিশোধাত্মক : এই মতবাদ অনুসারে বলা হয় যে, অপরাধের গুরুত্ব অনুযায়ী শাস্তি লঘু হবে, অপরাধ গুরুতর হলে শাস্তির পরিমাপও বাড়বে। এখানে কোন পরিস্থিতিতে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে তা জানার প্রয়োজন নেই। খুনের বদলে খুনই এর মূল নীতি। আদিম মানুষের মনোপ্রবৃত্তি এখানে প্রতিফলিত
হয়।
২.কোমল প্রতিশোধাত্মক : এখানে বলা হয়, শাস্তি দেবার সময় মাথায় রাখতে হবে, অপরাধী কি বাস্তব পরিস্থিতিতে, কোন মানসিক অবস্থায় অপরাধ করেছে অর্থাৎ 'দোষ নিবারক অবস্থাগুলি' বিচার করে দেখতে হবে।
শাস্তি সম্পার্ক সংশোধনাত্মক মতবাদ :-
যা বলতে চায় : এই মতবাদ সর্বদা বলতে চায় যে, অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার উদ্দেশ্য হল তার চরিত্রের সংশোধন বা তার অপরাধ প্রবণতার নিবারণ ঘটানো। অন্যভাবে বলা যায়, এই মতবাদ অপরাধীকে তার অপরাধ থেকে মুক্তি দিয়ে সুশিক্ষা দিয়ে তাকে পুনরায় সমাজে প্রতিষ্ঠা দিতে চায়। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, এখানে অপরাধীর উপায় নয়, উপায় হিসাবে ভাকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
সমাজ অপরাধ ও বিজ্ঞানীরা যা শেখান: বিজ্ঞান মনে করে, প্রতিটি অপরাধ একটি মানসিক অসুখ। তাই অপরাধীকে শাস্তির বদলে চিকিৎসা করা প্রয়োজন। সমাজবিজ্ঞানীরাও বলেন, কেউ কখনই স্বেচ্ছায় অপরাধ করতে চায় না। একজন মানুষের চারপাশে যদি উত্তাল তরঙ্গের মত দ্রুত অন্যায় বেড়ে উঠতে থাকে তবে একজন মানুষ তার মধ্যে কতক্ষণ স্থির থাকতে পারে? পারিপার্শ্বের উন্নতি না করে, দেশের অর্থনীতির কাঠামো না বদলে কোন মানুষকে শাস্তি দেওয়া মানে, একটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয় ।
স্বপক্ষে ফ্রয়েড : দার্শনিক ফ্রয়েড স্বভাব সিদ্ধভাবেই মনঃসমীকরণের সাহায্য নিয়ে বলেছেন, মনে যৌন ইচ্ছার অবদমনের ফলে অপরের ক্ষতি করার ইচ্ছা বলবতী হয়। একে তিনি spite wishes বলেছেন, তাই শাস্তির পরিবর্তে যৌন ইচ্ছার উৎসটি খুঁজে বার করে তার চিকিৎসা করার উপদেশ দিয়েছেন তিনি।
সমালোচনা : (i) একথা সত্য যে, চরিত্র সংশোধন ব্যাপারটা খুব সহজ নয় । দেখা যায় কারাগার বা হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর আবার সেই ব্যক্তি অপরাধে লিপ্ত হয়।
(ii) আমরা জানি সবাই মানসিক রোগী হতে পারে না। অনেকে সমাজের নৈতিকতা স্বেচ্ছায় লঙ্ঘন করে।
কোন রূপটি গ্ৰহনযোগ্য:
শাস্তি সম্পর্কে তিনটি মতবাবদের মধ্যে প্রতিশোধাত্মক মতের কোমল রূপটী আমাদের কাছে সন্তোষজনক ও গ্ৰহনযোগ্য।
No comments: