১৯৬৮ সালে ভারত সরকার কর্তৃক ঘোষিত জাতীয় শিক্ষানীতির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও ?

 1968 সালে ভারত সরকার কর্তৃক ঘোষিত জাতীয় শিক্ষানীতির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

উত্তর - স্বাধীনতা লাভের পর ভারতবর্ষে বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন গঠিত হলেও জাতীয় শিক্ষানীতি সম্পর্কে তাতে কোনো ঘোষণা ছিল না। ফলে বিভিন্ন রাজ্যে শিক্ষার মান নিয়ে বৈষম্য তৈরি হয়। কোঠারি কমিশন প্রথম কেন্দ্রীয় সরকারকে জাতীয় শিক্ষানীতি সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট ঘোষণা দেবার পরামর্শ দেয়। ফলস্বরূপ ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষানীতি নির্ধারণের জন্য পার্লামেন্টের সভ্য নিয়ে ভারত সরকার একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটির রিপোর্ট CABE আলোচনার পর ভারত সরকার কর্তৃক সমগ্র ভারতের জন্য 'জাতীয় শিক্ষানীতি' (১৯৬৮) ঘোষিত হয়। এই শিক্ষানীতিতে ১৭টি দফা ছিল। এই দফা বা শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন নীতি সংক্রান্ত প্রস্তাবগুলি হলো-

১.অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা : সংবিধানের 45 নং ধারানুসারে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত সকল শিশুর জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষায় অপচয় ও অনুন্নয়ন রোধের জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি নিতে হবে। বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া প্রত্যেক শিক্ষার্থী যাতে সাফল্যের সঙ্গে নির্দিষ্ট পাঠক্রম শেষ করতে পারে তা দেখতে হবে।


২.শিক্ষকদের মর্যাদা, বেতন ও শিক্ষণ ব্যবস্থা : শিক্ষাব্যবস্থার মান নির্ভর শিক্ষকের উপর। তাই শিক্ষকগণকে সমাজে সম্মানজনক স্থান দিতে হবে। তাঁদের যোগ্যতা ও দায়িত্বের কথা বিবেচনা করে বেতন ও চাকরির সুযোগ দিতে হবে। শিক্ষকরা যাতে স্বাধীনভাবে পড়াশোনা করতে পারেন, গবেষণা করতে পারেন, গবেষণাপত্র প্রকাশ করতে পারেন ও জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে বক্তব্য পেশ করতে ও লিখতে পারেন, সে বিষয়ে তাঁদের সুযোগ দিতে হবে। তাছাড়া শিক্ষক-শিক্ষণ বিশেষ করে চাকরিকালীন শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে।

৩.ভাষাসমূহের উন্নতি :

  • আঞ্চলিক ভাষাসমূহ : শিক্ষা ও সংস্কৃতির উন্নতির জন্য ভারতীয় ভাষা ও সাহিত্যের বলিষ্ঠ বিকাশ ঘটাতে হবে। ভাষার উন্নতি ছাড়া মানুষের উন্নতি সম্ভব নয়। তাই প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে আঞ্চলিক ভাষা শিক্ষার মাধ্যমরূপে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে এদের ব্যবহারকে প্রসারিত করতে হবে।
  • ত্রিভাষা সূত্র : মাধ্যমিক স্তরে ত্রিভাষা সূত্র রাজ্য সরকারকে গ্রহণ করতে হবে। এই ত্রিভাষার সূত্র হলো—একটি আধুনিক ভারতীয় ভাষা, হিন্দিভাষী রাজ্যে যেটি একটি দক্ষিণী ভাষা হওয়া উচিত এবং অহিন্দিভাষী রাজ্যে আঞ্চলিক ভাষা হবে হিন্দি এবং ইংরেজি। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে উন্নত মানের হিন্দি ও ইংরেজি শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • হিন্দি : হিন্দি ভাষার উন্নতির জন্য বিশেষ চেষ্টা করতে হবে। হিন্দিকে একটি যোগসূত্রকারী ভাষা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। এছাড়া অহিন্দি ভাষাভাষী রাজ্যে হিন্দি শিক্ষার জন্য কলেজ ও উচ্চশিক্ষার প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে।
  • সংস্কৃতি : ভারতীয় ভাষাসমূহের বিকাশ এবং সাংস্কৃতিক ঐক্য স্থাপনে সংস্কৃত ভাষার অবদান অপরিসীম। তাই বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে এই ভাষার চর্চার ক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে হবে। 
  • আন্তর্জাতিক ভাষা : ইংরেজি ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক ভাষা শিক্ষার উপর গুরুত্ব দিতে হবে।

৪.শিক্ষায় সমসুযোগ : সকলকে শিক্ষায় সমান সুযোগ দেবার চেষ্টা করতে হবে। 

• শিক্ষাক্ষেত্রে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করে গ্রাম এবং অনুন্নত অঞ্চলে শিক্ষার সুযোগসুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে।

• সামাজিক বৈষম্য দূর করতে হবে এবং জাতীয় সংহতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে সাধারণ স্কুল ব্যবস্থা চালু করতে হবে। বিদ্যালয় শিক্ষার মান উন্নত করতে হবে।


৫.প্রতিভা শনাক্তকরণ : যথাসম্ভব কমবয়সি প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের খুঁজে বের করে তাদের সবরকম প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধা দিতে হবে।

৬.কর্ম-অভিজ্ঞতা ও জাতীয় সেবা : বিদ্যালয় এবং সমাজের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ থাকবে। কর্ম-অভিজ্ঞতা ও সমাজসেবার মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসূচিতে যোগদান করা শিক্ষাসূচির একটি অঙ্গ। এই কর্মসূচি জাতীয় পুনর্গঠনেও সাহায্য করবে। এর ফলে স্বনির্ভরতা, চরিত্রগঠন ও সামাজিক দায়বদ্ধতার মনোভাব গড়ে উঠবে স্বাভাবিকভাবে।

৭.বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণা : দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার একান্ত প্রয়োজন। বিজ্ঞান ও গণিত বিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার অঙ্গ বলে বিবেচিত হবে। 

৮.শিল্প ও কৃষিশিক্ষা : শিল্প ও কৃষিশিক্ষার উন্নতির জন্য সুপারিশ হলো-

• কৃষিপ্রধান দেশ ভারতবর্ষ। তাই প্রতিটি রাজ্যে একটি করে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।

• কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে কলকারখানায় হাতেকলমে প্রশিক্ষণ এই শিক্ষার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হবে। কারিগরি শিক্ষা এবং গবেষণা শিল্পের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত।

•কৃষি, শিল্প এবং অন্যান্য কারিগরি বিষয়ে মানবশক্তির চাহিদার ক্রমাগত পর্যালোচনা করতে হবে।

৯.পাঠ্যপুস্তক প্রণয়ন : প্রতিভাবান লেখকদের দিয়ে উৎকৃষ্ট পাঠ্যপুস্তক রচনা করতে হবে। বিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ভালো মানের পাঠ্যপুস্তক রচনার ব্যবস্থা করতে হবে। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যপুস্তকের দাম কমাতে হবে এবং ঘন ঘন পাঠ্যপুস্তক পরিবর্তন করা চলবে না।

একটি স্বশাসিত পুস্তক আয়োগ গঠন করা যায় কি না তা বিবেচনা করে দেখতে হবে। সারা দেশে কয়েকটি সাধারণ পাঠ্যপুস্তক চালু করার চেষ্টা করতে হবে। শিশুদের থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত আঞ্চলিক ভাষায় পুস্তক রচনার জন্য সচেষ্ট হতে হবে।

১০.পরীক্ষা ব্যবস্থা : পরীক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার করতে হবে যাতে পরীক্ষার নির্ভরযোগ্যতা ও যথার্থতা বজায় থাকে। ধারাবাহিক মূল্যায়ন ব্যবস্থার প্রচলন করতে হবে।

১১.মাধ্যমিক শিক্ষা : যেসব অঞ্চল এবং শ্রেণি মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়েছে সেখানে মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। এছাড়া এই স্তরে বৃত্তিশিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষার ব্যবস্থা করতে মাধ্যমিক স্তরে কৃষি, শিল্প, ব্যাবসা বাণিজ্য, হস্তশিল্প প্রভৃতি বিষয় শিক্ষার সুযোগ দিতে হবে।

১২.বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা : বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংখ্যা নির্ভর করবে তার গবেষণাগার, গ্রন্থাগার ও অন্যান্য সুযোগসুবিধা কতটা আছে তার উপর।ও সবদিক বিচারবিবেচনা করে তবে নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।ও উচ্চশিক্ষার কেন্দ্রগুলিকে শক্তিশালী করতে হবে। গবেষণা ও প্রশিক্ষণের মান রক্ষা করে অল্প কয়েকটি কেন্দ্রগুচ্ছ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে গবেষণার সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।

১৩.আংশিক সময়ের শিক্ষা ও ডাকযোগে শিক্ষা : বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে আংশিক সময়ের শিক্ষা ও ডাকযোগে শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে। এই ধরনের শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে মাধ্যমিক স্তরে, শিক্ষকের শিক্ষাগত যোগ্যতা বৃদ্ধির জন্য এবং কৃষি, শিল্প বা অন্যান্য ক্ষেত্রের কর্মীদের জন্যও। পূর্ণ সময়ের শিক্ষার সমমর্যাদা দিতে হবে এধরনের শিক্ষাকে।

১৪.সাক্ষরতা প্রসার ও বয়স্কশিক্ষা : দেশের ও দশের উন্নতির জন্য নিরক্ষরতা দূরীকরণ জরুরি। এর জন্য ছাত্র ও শিক্ষককে আরও সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে। এছাড়া কমবয়সি কৃষিকাজে নিযুক্ত ব্যক্তিদের সাক্ষরতাদানে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে এবং তরুণ-তরুণীদের স্বনির্ভর কাজে প্রশিক্ষণ দিতে হবে।

১৫.খেলাধুলা : সমগ্র দেশব্যাপী খেলাধুলার জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করার কথা বলা হয়। এছাড়া যেখানে খেলাধুলার মাঠ ও শরীরচর্চার জায়গা নেই সেখানে বিভিন্ন সুযোগ দিয়ে খেলাধুলার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

১৬.সংখ্যালঘুদের শিক্ষা : সংখ্যালঘুদের শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এবং তাদের শিক্ষাগ্রহণে উৎসাহী করে তুলতে হবে।

 ১৭.শিক্ষা কাঠামো : সমগ্র দেশের জন্য মোটামুটিভাবে একইরকম শিক্ষার কাঠামো চূড়ান্ত করা হয়। তা হলো ১০+২+৩। স্থানীয় অবস্থা অনুসারে দু'বছরের উচ্চ মাধ্যমিক স্তর স্কুল বা কলেজের সঙ্গে যুক্ত হবে।

উপরিউক্ত শিক্ষা পুনর্গঠন সংক্রান্ত নীতিগুলি কার্যকরী করার জন্য প্রয়োজন শিক্ষাখাতে আরো বেশি খরচ করা। এজন্যজাতীয় আয়ের 6% অন্তত শিক্ষাখাতে ব্যয় করা প্রয়োজন।

শিক্ষার সংস্কার কাজটি সহজ নয় একথা ভারত সরকার উপলব্ধি করেছিল। অর্থের অভাব ছাড়াও আরো সমস্যা রয়েছে। বস্তুসম্পদ ও মানববিকাশের ক্ষেত্রে শিক্ষা, বিজ্ঞান ও গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা বিবেচনা করে ভারত সরকার রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় কর্মসূচিকে রূপায়ণ সক্রিয়ভাবে করবে।

ভারত সরকার প্রতি পাঁচ বছর অন্তর শিক্ষার অগ্রগতি পর্যালোচনা করবে ও ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য নির্দশনা দেবে।

No comments:

Powered by Blogger.