কোচ শক্তি উদ্ভব সম্পর্কে লেখ।
উত্তর:- কর্ণেল শেক্সপীয়ার History of Upper Assam গ্রন্থে শাঙ্কিলদীপ বা সাঙ্গল দেব-এর অভ্যুত্থানের দিন থেকেই কোচ রাজত্বের অভ্যুত্থানকালে বলে গণ্য করতে চেয়েছেন। তাঁর মতে বর্তমান কোচবিহার রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বিশ্বসিংহের অনেক পূর্বেই সাঙ্গল দেবের (শঙ্কিল দীপ) নেতৃত্বে কোচ রাজত্বের প্রথম প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল। ১৯৬ খ্রিস্টাব্দের বাণ-গড়-লিপিতেই সন্ধান পাওয়া যায়, গৌড়ের পরবর্তী রাজা মহীপালের হাতে কোচ রাজার পরাজয় ঘটে। তবুও কিন্তু স্বল্পকালের জন্যে হলেও তাঁদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা অস্বীকার করা যায় না। তবকাত-ই-নাসিরি (TABAQAT-I-NASIRI) প্রদত্ত বিবরণে দেখা যায়, ১২০৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে এই অঞ্চলে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যে তুর্কীদের আক্রমণকালে প্রকৃতপক্ষে এখানে KWNC, NYZ এবং THARW অর্থাৎ কোচ-মেচ-থারু জনগোষ্ঠীর আধিপত্য ছিল। ১২৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রকৃতপক্ষে এই অঞ্চলে কোচদেরই যে আধিপত্য ছিল, সে সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের সুস্পষ্ট নির্দেশ পাওয়া যায়। “A number of Koch Chieftainships or principalities appear to have been on occupation of the entire country from the Bharali to Tista and Karatoya rivers and beyond, probably also including Dinajpur Distinct during 1250 to 1500 A.D."(KIRATA-JANA-KIRTI)।
১৪১৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার ইতিহাসে যে হিন্দুরাজা দনুজমর্দন দেবের নাম পাওয়া যায়, তিনিও ভারতীয় মোঙ্গলদের বংশোদ্ভূত এবং কোচ জনগোষ্ঠীর বলে কেউ কেউ মনে করেন। KIRATA JANA-KRITI গ্রন্থের ৬০ পৃষ্ঠায় ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেন, “Danuj-mardan tried to effect an Hindu revival in Bengal. Danuj-mardan may have been just one of the Notth Bengal Koch chief who with his sturdy Koch 'Paiks' created a diversion in favour of the Hindus by scizing the Kingship of Bengal repaling the beat of the Koch Conquerors of Bengal throne in the 10th century.” একথাও কেউ কেউ মনে করেন যে দনুজমর্দনই রাজা গণেশ, যিনি ৮১৩ হিজরী অর্থাৎ ১৪১০ খ্রিস্টাব্দে ছিলেন বাংলার রাজা। বলা হয়, তিনি হিন্দুধর্ম গ্রহণ করেই সিংহাসনে আরোহন করেন। এন. কে. ভট্টশালী প্রণীত Coins and Chronology of the Early Independent Suttans of Bengal গ্রন্থে একথা জানা যায়। গৌরবঙ্গের আধিপত্য বিস্তারে সপ্তগ্রাম অধিকারের চেষ্টা করলে জালালউদ্দিনের সঙ্গে যুদ্ধে দনুজমর্দন দেব নিহত (সম্ভবত) হন। এরপরে মহেন্দ্র দেব রাজা হন এবং ১৪১৮ খ্রিস্টাব্দে মুদ্রা প্রচার করেন। মুসলিম শাসনের মধ্যভাগে অধিকাংশ অঞ্চলই যে কিছু সময়ের জন্যে (১৪১৬-২০) হিন্দু শাসনে চলে এসেছিল, প্রাপ্ত মুদ্রার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণের ভিতর দিয়ে সন্দেহাতীতভাবে সত্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়। দনুজমর্দন দেবের সময় প্রচলিত মুদ্রা এক পিঠে শ্রী দনুজমর্দন দেব' অন্য পিঠে শ্রী চণ্ডীচরণ পরায়ণ' মুদ্রিত থাকার রীতিতে পরবর্তীকালের ভারতীয় মোঙ্গল রাজন্যবর্গকেও গ্রহণ করতে দেখা যায়।
কোচবিহার-রাজ নর নারায়ণ নিজ মুদ্রার এক পিঠে শ্রী শ্রীমন নরনারায়ণস্য ভূপালস্য শাকে ১৪৭৭” অর্থাৎ ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে এবং অন্য পিঠে “শ্রী শ্রী শিবচরণ-কমল-মধুকরস্য” কথাগুলি মুদ্রিত। অহোম এবং জয়ন্তিয়া রাজবংশের ভারতীয় মোঙ্গল রাজন্যগণও মুদ্রা নির্মাণে এই রীতি অনুসরণ করেছিলেন। সুতরাং দনুজমর্দন দেবকে ভারতীয় মোঙ্গল বংশের সন্তানরূপে গ্রহণের পক্ষে একটি সমর্থন পাওয়া যায়।
সে যাই হোক, ভারতীয় মোঙ্গল লোকগোষ্ঠীর মানুষ কোচদের আধিপত্য এই অঞ্চলে দীর্ঘকাল থেকেই বর্তমান ছিল, ঐতিহাসিকদের বিবরণ থেকে সে নির্দেশ পাওয়া যায়। কম্বোজরাও তিব্বত, ভূটান প্রভৃতি হিমালয়ের সানুদেশের কোনও মোঙ্গলীয়জনের শাখা এবং বর্তমান উত্তরবঙ্গের কোচ-পালিয়া-রাজবংশীদের পূর্বপুরুষ বলে অনেকেই সত্যে উপনীত হয়েছেন। তবে বৃহদ্ধর্ম পুরাণ এবং ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে জানা যায়, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকা থেকে আগত মোঙ্গলীয় নরগোষ্ঠী কামতাপুরের জনপ্রবাহে মিলিত হয়েছে। একথা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং রমাপ্রসাদ চন্দ্র মহাশয় সমর্থন করেছেন। প্রাচীন কামরূপ রাজ্যের সীমাব মধ্যেই ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার পশ্চিমপ্রান্তে খেন রাজবংশের প্রতিষ্ঠা ঘটে। বাহিরীস্থান-মাইবী গ্রন্থের ৮০৬ পৃষ্ঠায় কামতাপুর রাজ্যের আয়তন সম্পর্কে বলা হয়েছে, “Kamta originaly denoted the Western part of Brahmaputra Valley and it was included within the ancient kingdom of Kamrupa." এস. এন. ভট্টাচার্যের ।
No comments: